পবিত্র কোরআনের এমন কিছু আয়াত বা আয়াতাংশ আছে, যা তিলাওয়াত করলে পাঠকারীর ওপর সিজদা ওয়াজিব হয়। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় এমন সিজদাকে ‘সিজদায়ে তিলাওয়াত’ বা তিলাওয়াতের সিজদা বলা হয়। নিম্নে সিজদায়ে তিলাওয়াতের বিধান ও তা আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো— সিজদার আয়াতগুলো : হানাফি মাজহাব মতে, পবিত্র কোরআনের ১৪টি সিজদার আয়াত হলো—ক. সুরা আরাফ, আয়াত ২০৬, খ. সুরা রাদ, আয়াত : ১৫, গ. সুরা নাহল, আয়াত : ৪৯, ঘ. সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১০৯, ঙ. সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৮, চ. সুরা হজ, আয়াত : ১৮, ছ. সুরা ফোরকান, আয়াত : ৬০, জ. সুরা নামল, আয়াত : ২৬, ঝ. সুরা সিজদা, আয়াত : ১৫, ঞ. সুরা সাদ, আয়াত : ২৫, ট. সুরা হা-মিম সিজদা, আয়াত : ৩৮, ঠ. সুরা নাজম, আয়াত : ৬২, ড. সুরা ইনশিকাক, আয়াত : ২১, ঢ. সুরা আলাক, আয়াত : ১৯।
বিধান ও দলিল : হানাফি মাজহাব অনুসারে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে বা তা শুনলে ব্যক্তির ওপর সিজদা করা ওয়াজিব। তবে অন্য ইমামদের মতে, তা সুন্নত। সিজদায়ে তিলাওয়াত ওয়াজিব হওয়ার দলিল নিম্নরূপ—১. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সেসব মানুষের নিন্দা করেছেন, যারা সিজদার আয়াত তিলাওয়াতের পর সিজদা করে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাদের সামনে কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তারা সিজদা করে না।’ (সুরা ইনশিকাক, আয়াত : ২১) ২. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। তিনি এমন একটি সুরা তিলাওয়াত করলেন, যাতে সিজদা (আয়াতে সিজদা) ছিল। তিনি সিজদা দিলেন এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে সিজদা দিলাম। এমনকি আমাদের ভেতর কেউ কেউ কপাল রাখার জায়গা পেল না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৭৫) কার ওপর ওয়াজিব : সিজদায়ে তিলাওয়াত ওয়াজিব যে ব্যক্তি তিলাওয়াত করে এবং যে ব্যক্তি তা শোনে।
চাই সে ইচ্ছায় শুনুক অথবা অনিচ্ছায় শুনুক। যদি ব্যক্তি মুসলিম, সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হয় এবং সিজদা আদায়ে শরিয়তসম্মত কোনো বাধা না থাকে। যেমন—ঋতুমতী নারী। এই হিসেবে পাগল, শিশু ও অপ্রকৃতিস্থ মানুষের ওপর সিজদায়ে তিলাওয়াত ওয়াজিব নয়। কখন আদায় করবে : উত্তম হলো তিলাওয়াতের সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় করা। তবে আয়াতটি যদি নামাজের বাইরে পাঠ করা হয়, তাহলে বিলম্বে আদায় করা বৈধ। কিন্তু নামাজের ভেতর তিলাওয়াত করলে নামাজের ভেতরেই তা আদায় করা ওয়াজিব। কেননা তা নামাজের অংশে পরিণত হয়। কিভাবে আদায় করবে : নামাজের জন্য যেভাবে পবিত্রতা অর্জন করা হয়, সিজদায়ে তিলাওয়াতের জন্য সেভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে। হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, সিজদায়ে তিলাওয়াতের জন্য তাকবিরে তাহরিমা, সময় নির্ধারণের নিয়ত ও সালামের প্রয়োজন নেই।
শুধু পবিত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে একটি তাকবির দিয়ে সিজদা করলে তা আদায় হয়ে যাবে। পুরুষের জন্য তাকবির জোরে পাঠ করা উত্তম। নামাজের সিজদা যেভাবে করা হয়, তিলাওয়াতের সিজদাও সেভাবে করা হয়। নামাজের ভেতর সিজদায়ে তিলাওয়াত আদায়ের নিয়ম হলো—আয়াত তিলাওয়াতের পর তাকবির বলে সিজদা আদায় করা এবং উঠে আরো কয়েক আয়াত তিলাওয়াত করে রুকুতে যাওয়া। তবে কেউ যদি সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সরাসরি রুকুতে চলে যায় এবং নামাজের সিজদার সঙ্গে তিলাওয়াতে সিজদারও নিয়ত করে ফেলে, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে। শর্ত হলো সিজদার আয়াত তিলাওয়াতের পর দুই আয়াতের বেশি তিলাওয়াত না করা। সংশ্লিষ্ট মাসআলা : সিজদায়ে তিলাওয়াত বিষয়ক জরুরি কিছু মাসআলা নিম্নে তুলে ধরা হলো—
১. একটি সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে একবার সিজদা করা ওয়াজিব। ২. এক বৈঠকে একাধিক আয়াত তিলাওয়াত করলে একটি সিজদাই যথেষ্ট হবে। তবে একাধিক সিজদা দেওয়া উত্তম।
৩. কোনো বৈঠকে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত হলে বৈঠকে উপস্থিত সবার জন্য সিজদা করা ওয়াজিব। ৪. রেকর্ডকৃত সিজদার আয়াত শুনলে বা রেডিও-টেলিভিশনের তিলাওয়াতে সিজদার আয়াত শুনলে সিজদা দেওয়া ওয়াজিব নয়। ৫. বুঝমান নাবালেগ শিশু থেকে সিজদার আয়াত শুনলেও শ্রোতার ওপর সিজদায়ে তিলাওয়াত ওয়াজিব হয়। যদি কেউ পাগল বা অবুঝ নাবালেগ শিশু থেকে সিজদার আয়াত শোনে, তাহলে তার ওপর সিজদা ওয়াজিব হবে না।
৬. নামাজরত ব্যক্তি যদি বাইরের লোকের কাছে অথবা বাইরের লোক নামাজরত ব্যক্তির কাছে আয়াতে সিজদা শোনে, তাহলেও তাদের ওপর সিজদা ওয়াজিব হবে। তবে নামাজরত ব্যক্তি নামাজ শেষ করে আলাদাভাবে সিজদা আদায় করবে। ৭. পুরো কোরআনের তিলাওয়াত শেষ করে একবারে ১৪টি সিজদা আদায় করাও জায়েজ হবে। তবে তিলাওয়াতের সঙ্গে সঙ্গে আদায় করাই উত্তম। ৮. কারো যদি অনেক সিজদায়ে তিলাওয়াত অনাদায়ি থাকে, তবে সে সংখ্যা নির্ধারণের চেষ্টা করবে। নির্ধারণ করা সম্ভব হলে সেই সংখ্যক সিজদা আদায় করবে। আর সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব না হলে মনে প্রশান্তি আসা পর্যন্ত সিজদা আদায় করবে।
৯. তিলাওয়াতের সিজদার সময় দাঁড়ানো থেকে সিজদায় যাওয়া এবং সিজদা করে আবার দাঁড়িয়ে যাওয়া উভয়টিই মুস্তাহাব। তাই একাধিক তিলাওয়াতের সিজদা আদায় করতে চাইলে এভাবেই করা উচিত। তবে বসে বসে সিজদা করলেও সিজদা আদায় হয়ে যাবে। ১০. আসরের পর সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করা যাবে সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সূর্য হলুদ হয়ে গেলে অস্ত যাওয়া পর্যস্ত সিজদায়ে তিলাওয়াত আদায় করা যাবে না।
তথ্যঋণ : আল-ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবাআ, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ও রদ্দুল মুহতার
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।